বহিপীর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর একটি নাটক। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা সমাজজীবনের জন্য কতটুকু গুরুত্ববহ তা প্রশ্নবিদ্ধ। আজও শিক্ষা-সৌন্দর্যহীন অজ্ঞ কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবন চলে আসছে জরাজীর্ণ পুঁথির জ্ঞানকে আঁকড়ে। জীবনের আনন্দ, জীবনের সৌন্দর্য সেখানে অনুপস্থিত। সমাজজীবনকেন্দ্রিক রূপকাশ্রিত এমন নানা ভাবধারা নিয়ে রচিত বহিপীর। বহিপীরের রচয়িতা কথাশিল্পী ও নাট্যকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। বাংলা ভাষার প্রতিথযশা এই কথাশিল্পী মাত্র কয়েকটি উপন্যাস, নাটক ও অল্প কিছু গল্প লিখলেও তার লেখার বিষয়, ভাষা ও জীবনঘনিষ্ঠতা তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে অন্যতম স্থানে আসীন করেছে। এটি ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৯৫৫ সালে ঢাকায় পিইএন ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে “বহিপীর” নাটক পুরস্কার লাভ করে। বহিপীর নাটকটি উনিশ শতকের শেষভাগ বা বিশ শতকের সূচনালগ্নের পটভূমিতে লেখা। নাটকে দেখা যায়, জমিদার হাশেম আলি সূর্যাস্ত আইনে জমিদারী হারাতে বসেছেন। সূর্যাস্ত আইন প্রণীত হয় ১৭৯৩ সালে আর এ আইনে জমিদারী হারাতে থাকে এ সময় পর্যন্ত। সে সময়ে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেঁকে বসা পীরপ্রথা, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার ফুটে উঠেছে এ নাটকে। পীরসাহেবকে ধনী গরিব সবাই অসম্ভব ভয় করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ পীরকে পেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ধন সম্পদ এমনকি নিজের কন্যাকেও দান করে দেয়। এ নাটকটি শেষ পর্যন্ত আলোর পথ দেখায় ও এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয়।
বহিপীর নামটির একটি প্রতীকী তাৎপর্যও রয়েছে। মূলত মুসলমান সমাজে পীরপ্রথার সৃষ্টি হয় কুসংস্কার ও ধর্মীয় বইয়ের পাতা থেকে। মূলত ইসলাম ধর্মের সুফিবাদী ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই পীর সমাজের সৃষ্টি। সে হিসেবে ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও মাসায়েল বইয়ের পাতা থেকে মানুষের সংস্কারকে পুঁজি করে ছড়িয়ে পড়া পীরপ্রথাকে তুলে ধরতে বহিপীর নামটি সার্থক।
বহিপীর নাটকের মূল চরিত্রগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো –
বহিপীর
বহিপীর নাটকের কেন্দ্রীয় ও নাম চরিত্র, বাড়ি উত্তরের সুনামগঞ্জ। সাধারণ কথ্য ভাষা তার কাছে অপবিত্র হওয়ায় তিনি বহি বা বইয়ের ভাষায় কথা বলেন, এজন্য তার নাম বহিপীর। নাটকে তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমান লোক। চৌদ্দ বছর আগে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর মুরিদের কন্যা তাহেরাকে বিয়ে করেন। নাটকে তার ধূর্তবুদ্ধি ও বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।
তাহেরা
তাহেরা নাটকের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। মাতৃহীন তাহেরাকে তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাবা আর সৎমা বৃদ্ধ বহিপীরের সাথে বিয়ে দেন নেকির আশায়। কিন্তু তাহেরা এ বিয়ে মেনে নিতে না পেরে চাচাত ভাইয়ের সাথে পালিয়ে হাতেম আলির বজরায় আশ্রয় নেয়। নাটকে তাহেরা অনমনীয় ও মানবিক চরিত্র। তাহেরাকে বিশ শতকের প্রারম্ভে নারী অধিকার ও জাগরণের প্রতীক বলা যায়।
হাশেম আলি
নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। নাটকে বহিপীর খলনায়ক হলে হাশেম হলো নায়ক। জমিদারপুত্র হাশেম ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক চরিত্র।
হাতেম আলি
হাতেম আলি রেশমপুরের এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার। খাজনা বাকি পড়ায় তার জমিদারী সূর্যাস্ত আইনে নিলামে উঠেছে। জমিদারী রক্ষার জন্য বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইতে চিকিৎসার বাহানায় শহরে আসেন। বহিপীর তার অসহায়ত্বের সুযোগ নেন। কিন্তু হাতেম আলি বহিপীরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দেন।
খোদেজা বেগম
জমিদারগিন্নি খোদেজা বেগম সাদামাটা ধর্মভীরু ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি চরিত্র। নাটকে তিনি অচেনা অসহায় মেয়ে তাহেরাকে আশ্রয় দিয়েছেন, মেয়েটির দুঃখের কাহিনী জেনে ব্যথিত হয়েছেন। আবার মেয়েটি পীরের পালিয়ে আসা স্ত্রী জেনে তাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন। উপলব্ধি করেছেন তাহেরার এ বিয়েটি অন্যায়, কিন্তু পীরের অভিশাপের ভয়ে চুপ থেকেছেন। ছেলে হাশেম আর বহিপীর মুখোমুখি অবস্থান নিলে পীরের পক্ষ নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে চেয়েছেন, কিন্তু ছেলেকেও শক্তভাবে দমন করতে পারেন নি। খোদেজার মধ্যে চিরায়ত মায়ের প্রতিমূর্তি ফুটে উঠেছে।
হকিকুল্লাহ
হকিকুল্লাহ পীরের ধামাধরা ব্যক্তিত্বহীন একটি চরিত্র। সে বহিপীরের সহকারী। নাটকে সে পীরের আজ্ঞা পালন করেই চলেছে।
মূল গল্পটা সংক্ষেপে নিম্নোক্তভাবে বলা যায়-
এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো বহিপীর। তিনি অত্যান্ত ধূর্ত ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। তিনি অশিক্ষিত সাধারন মানুষের কুসংস্কার ও ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে তাঁর ধর্মব্যবসা পরিচালনা করেন। তিনি সারাবছর তাঁর মুরিদদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। তাদের কাছ থেকে অর্থসম্পদ সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে তাঁর এক মুরিদ ও স্ত্রী মিলে তাঁদের মেয়েকে পীরের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু এ বৃদ্ধ পীরের সাথে বিয়ে তাহেরা মেনে নিতে পারেননি। তাই তাঁর ছোট চাচাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ডেমরার ঘাটে পৌঁছে ছেলেটি কাঁদতে শুরু করে। অবশেষে মেয়েটি এক জমিদারদের বজরায় আশ্রয় পায়। মেয়েটি পালিয়ে যাওয়ার পরেই বহিপীর তাঁকে খুঁজতে বের হন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি যে নৌকা নিয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হন সেই নৌকাটা বজরার সঙ্গে ধাক্কা লেগে নৌকাটা আধ ডোবা হয়ে যায়। তারপর সেই বজরায়ই তিনি এবং তাঁর সঙ্গী হকিবুল্লাহ। কিন্তু বহিপীর জানতো না যে তাঁর স্ত্রী এই বজরাতেই আছে। এমনকি তাহেরাও তা জানতো না। আর এদিকে জমিদার হাতেম আলী তাঁর জমিদারি হারাতে বসেছে। রেশমপুরে তাঁর যৎ কিঞ্চিৎ জমিদারি আছে। তাও এখন সূর্যাস্ত আইনে নিলামে উঠেছে। এ বিষয়ে তাঁকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কিছুই জানে না। তিনি ডাক্তার দেখানোর কথা বলে তাঁর এক বাল্যবন্ধু আনোয়ার উদ্দিনের কাছে সাহায্য চাইতেই এসেছিল এখানে। কিন্তু এখানে এসে কোনো কিছুই হলো না। তাই তিনি খুবই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই বহিপীর তাকে সবকিছু খুলে বলবার জন্য বলে। তারপর জমিদার হাতেম আলী তাঁর জমিদারি নিলামে উঠার সব কথা তাকে খুলে বলে। তারপর বহিপীর তাকে সান্তনা দেয়। তারপর বহিপীরও তার আসল কথা বলতে থাকে যে, বিয়ের রাতে তাঁর বিবি পালিযে যায়। আর সৌভাগ্যক্রমে তিনি আপনাদের বজরাতেই আছে। আপনারা যাকে কাল ডেমরার ঘাট থেকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনিই আমার পলাতকা বিবি। আর তাঁকে খুঁজতেই আমি এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আমাকে মানতে চায় না। তারপর তিনি বলেন, হাশেমকে ডেকে মেয়েটির পরিচয় জানতে। কিন্তু হাশেম তার পরিচয় বহিপীরের কাছে দিলেন না। কিন্তু হাশেমের মা খোদেজা বহিপীরকে বলে দেয় যে, তার বিবি তাদের সঙ্গেই আছেন। বহিপীর এ কথা শুনে শোকর আদায় করে। বহিপীর বারবার হাশেম মিঞাকে ডাকেন। এতে হাশেম মিঞা বিরক্ত হন। এতে তাহেলা বলে, আপনার এসব ভালো না লাগলে আপনি আর কষ্ট করবেন না। আমিই পীর সাহেবকে বলব। কিন্তু হাশেম বাঁধা দেয়। হাশেম বলে, মত না থাকলে কোনো বিয়ে জায়েজ হতে পারে না। তারপর হাশেম বহিপীরের কাছে চলে যান। তারপর বহিপীর তাহেরার সাথে কথা বলার জন্য হাশেম মিঞাকে বলে মাঝখানের দরজাটা খুলে দিতে। তারপর হাশেম মিঞা দরজাটা একটু খুলে দেয়্। তারপর পীর সাহেব তাহেরাকে তাঁর সঙ্গে যেতে বলে। কিন্তু সে যেতে রাজি হয় না। সে বলে, তাকে জোর করলে সে আত্মহত্যা করবে। তারপর পীর সাহেব রেগে তাঁর সঙ্গী হকিকুল্লাহকে বলে পুলিশ ডাকতে। এ কথা শুনে তাহেরা দ্রুতপায়ে জানালা দিয়ে গলা বের করে দিতেই খোদেজা দু’হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু তিনি ধরে রাখতে পারছেন না। তাই হাশেম দ্রুতপায়ে পীর সাহেবকে ডিঙিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে তাহেরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে। এদিকে পীর সাহেব হাশেম মিঞাকে বলেন, আমার বিবি সাহেবের হাত ছেড়ে দিন। আমার বিবির গায়ে হাত দিবেন না। তারপর হাশেম একটু রেগে গিয়ে বলে, হাত না দিলে তাঁকে বাঁচাত কে? এদিকে হকিকুল্লাহ এসে পীর সাহেবকে বলে পুলিশ ডাকলে লোকে জানাজানি হবে। মান সম্মান যাবে। এদিকে হাশেম তাহেরাকে বাঁচাতে বিয়ে করতে পর্যন্ত রাজি। এদিকে হাশেমকে তাঁর বাবা হাতেম আলী ডাকছেন। তারপর হাশেম চলে যায় পাশের কামরায়। হাতেম আলী এখন তার আসল কথা হাশেমকে জানিয়ে দিতে চায় যে, তিনি এখানে চিকিৎসার জন্য আসেনি, এসেছিল জমিদারি রক্ষা করতে। এ কথা শুনে হাশেম একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। আর পাশের কামরায় গিয়ে বেঞ্চিতে বসে পড়ে। এদিকে তার মা বলে, তোর আব্বা কী বললেন? তাহেরাও উৎকণ্ঠা দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। তারপর হাশেম বলল, কাল আমাদের জমিদারি নিলামে উঠবে। এ কথা শুনে খোদেজা চমকে উঠে। হাশেম কাঁদতে শুরু করে তাঁর বাবার মানসিক কষ্টের কথা ভেবে। হাতেম আলী পাশের কামরা থেকে দরজা খুলে বলে, আমার ছেলেটাকে ছাপাখানা করার পয়সা কখনো দিতে পারবো না। হাশেমের অনেক ইচ্ছে ছিল ছাপাখানা দেওয়ার। সে চেঁচিয়ে বলে, আমি পয়সা চাই না, ছাপাখানাও চাই না। এদিকে পীর সাহেব হাতেম আলীকে জমিদারি রক্ষা করার জন্য টাকা কর্জ দিবে বলে। কিন্তু এক শর্তে যে, তার বিবিকে তার সঙ্গে ফিরে যেতে হবে। এ কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কেউই ভেবে কুল কিনারা পায় না। তাহেরা বলে উঠে, আমি তার সঙ্গে যেতে রাজি। তবে তাকে আগে আপনাদের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। কিন্তু এটা তাঁর মনের কথা নয়। এদিকে হাতেম আলী বলছে, আজ যেন নিজেকে কসাই মনে হচ্ছে। এবার হাতেম আলী বহিপীরের কাছে গিয়ে বলে, তিনি যেতে রাজি আছেন। কিন্তু আমি রাজি নই। আমি এভাবে টাকা নিতে পারব না। যায় যাক জমিদারি। একথা শুনে পীর সাহেব বলেন, আমি বিনা শর্তে আপনাকে টাকা দিতে রাজি আছি। হাশেমও বলছে, টাকা আমাদের চাই না। এসব বলে হাশেম তাহেরার হাত ধরে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাদেরকে আটকাতে চাইলে পীরসাহেব তাদেরকে আটকাতে বাঁধা দেয়। এতক্ষণে তাঁরা তীরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর তাদের যাওয়ার সাথে সাথেই সব ঝড় থেমে গেল। আর বহিপীর বলে, চলুন জমিদার সাহেব, আমরা আপনার জমিদারি রক্ষা করার ব্যবস্থা করি।